মন্ত্রী-এমপির তদবিরে বদলে গেল সীমানা

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০টির সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি আসনের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস করে নামে বদল আনা হলেও বাস্তবে সীমানার কোনো তারতম্য হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, সীমানা পুনর্নির্ধারণে মন্ত্রী-এমপিদের তদবির আমলে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তুষ্ট করে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর ইসি বলছে, সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে কাউকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট করা যায় না। এর পক্ষে-বিপক্ষে অভিযোগ উঠবেই। ১ জুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব জাহাংগীর আলমের সই করা প্রজ্ঞাপনটি গতকাল শনিবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

সীমানায় পরিবর্তন আনা আসনগুলো হলো– পিরোজপুর-১, পিরোজপুর-২, কুমিল্লা-১, কুমিল্লা-২, ফরিদপুর-২, ফরিদপুর-৪, গাজীপুর-২, গাজীপুর-৫, নোয়াখালী-১ ও নোয়াখালী-২। গত ফেব্রুয়ারিতে ইসির খসড়ার ওপর স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের দাবি-আপত্তি জানানোর সময় দেওয়া হয়েছিল। সেসব দাবি-আপত্তি নিয়ে শুনানি শেষে নতুন সীমানা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

একইভাবে কুমিল্লার সরকারদলীয় এমপি সুবিদ আলী ভূঁইয়ার আগ্রহে দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-১ আসনের সীমানায় বদল আনা হয়েছে। মেঘনা বাদ দিয়ে এখানে তিতাসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া পিরোজপুর-১ ও ২ আসনের পরিবর্তনের পেছনে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অধ্যক্ষ শাহ আলমের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ ছিল।

এবারের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অন্তত ৭৫ সংসদীয় আসনে সংশ্লিষ্ট জেলার গড় জনসংখ্যার চেয়ে ২৬ থেকে ৮৮ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ আসনে জনসংখ্যার ব্যবধান ৫১ থেকে ৮৮ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, সর্বোচ্চ ৫ থেকে ২৫ শতাংশ জনসংখ্যার পার্থক্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য।

সূত্র জানায়, গাজীপুরে সীমানা পরিবর্তনের পেছনে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করেছে। কারণ, গাজীপুর সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের পুবাইল থানার শকুন্দির বাগ এলাকায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি। শকুন্দির বাগ নিজের নির্বাচনী এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করতে এলাকাবাসীর মাধ্যমে ইসিতে আবেদন করিয়েছিলেন তিনি। ওই আবেদনে পুবাইলের সব ক’টি ওয়ার্ড গাজীপুর-২ আসনে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করা হয়েছিল। তবে গাজীপুর-৫ আসনের চেয়ে গাজীপুর-২ আসনের ভোটার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।

গাজীপুর সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শাহীনূল আলম মৃধা জানান, প্রতিমন্ত্রীর পৈতৃক ভিটা এই ওয়ার্ডে, তাই এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর মাসুদুল হাসান বিল্লাল অবশ্য বলছেন, এলাকাবাসীর পক্ষে এমন কোনো আবেদনের ব্যাপারে তিনি জানেন না। তাঁর মতে, গাজীপুর-৫ আসনেই থাকা ভালো ছিল। কারণ, সেখানে ভোটার কম। গাজীপুর-২ আসনে এমনিতেই ভোটার বেশি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছোট আসনের অংশ কেটে বড় আসনের সঙ্গে যুক্ত করা কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ হতে পারে না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তুষ্ট করতে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইসির এ ধরনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসির সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সমকালকে বলেন, সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে কাউকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট করা যায় না। যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, এর পক্ষে-বিপক্ষে অভিযোগ উঠবেই। প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্বার্থে গাজীপুর আসনের সীমানা পাল্টানোর বিষয়ে তিনি জানান, গেজেট প্রকাশ হলেও তিনি এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অবগত নন। গেজেটটি তিনি নিজেও ভালোভাবে দেখেননি। এ নিয়ে আজ (রোববার) দুপুরে তিনি তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান।

আগে কুমিল্লা-১ আসন ছিল দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা। নতুন সীমানায় দাউদকান্দির সঙ্গে তিতাসকে যুক্ত করা হয়েছে। কুমিল্লা-২ আসন ছিল হোমনা ও তিতাস নিয়ে, নতুন সীমানায় হোমনা ও মেঘনা নিয়ে এই আসন গঠন করা হয়েছে।

কুমিল্লার আসন পরিবর্তন নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষই মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। ইসির আয়োজিত শুনানিকালেও ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে হাতাহাতিতে জড়ান তাঁরা।

তিতাস উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকার বলেন, তিতাসে ভোটার দেড় লাখ, দাউদকান্দিতে চার লাখ। এতে ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। তবে এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়ার ছেলে ও দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী সুমন সমকালকে বলেন, ইসির এ সিদ্ধান্তে তাঁরা সন্তুষ্ট। কারণ কুমিল্লা-১ আসনের সঙ্গে তিতাস যুক্ত হওয়ায় যাতায়াতসহ সব দিক থেকে এলাকাবাসী উপকৃত হবে।

কুমিল্লার আসন বদলে রীতিমতো কমিটি করে আন্দোলনও করা হয়েছে। এই কমিটির আহ্বায়ক ও মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিকুল আলম সমকালকে বলেন, ২০০৮ সালে অন্যায়ভাবে মেঘনাকে কেটে দাউদকাান্দির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে নদীবেষ্টিত এই উপজেলাবাসী দুর্ভোগে পড়েন।

পিরোজপুর-১ আসনে ছিল সদর উপজেলা, নাজিরপুর ও নেছারাবাদ। নতুন সীমানায় এই আসনের মধ্যে থাকছে সদর উপজেলা, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী। পিরোজপুর-১ আসন থেকে বাদ পড়া নেছারাবাদকে সঙ্গে নিয়ে কাউখালী ও ভাণ্ডারিয়াকে যুক্ত করে পিরোজপুর-২ আসন গঠন করা হয়েছে।

সীমানা পরিবর্তন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি-জেপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, পিরোজপুর-১ ও পিরোজপুর-২ আসনের সীমানা পরিবর্তন নেতাদের ইচ্ছার প্রতিফলন। সরকারদলীয় কোনো কোনো নেতা পরিবর্তিত এ সীমানার জন্য অনেক আগে থেকেই নানা তদবির চালিয়েছেন।

পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ শাহ আলম জানান, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি), কাউখালী ও ভাণ্ডারিয়া নিয়ে একটি আসন হওয়ায় এলাকাবাসী খুশি। তাঁর যুক্তি, ভৌগোলিক দিক থেকে নেছারাবাদের সঙ্গে কাউখালী ও ভাণ্ডারিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো।

পিরোজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন মহারাজ জানান, নতুন সীমানা পরিবর্তনে পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের জন্য একটা সুখবর রয়েছে। নতুন বিন্যাসের ফলে পিরোজপুর জেলায় আওয়ামী লীগের আসন বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা আগের সীমানার আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন মাত্র একজন। অন্য দুটি আসনে নানা কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হতে পারতেন না। নতুন সীমানায় জেলার তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ছাড়া ইসির নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নগরকান্দা ও সালথা নিয়ে ফরিদপুর-২ আসন গঠন করা হয়েছে। এই আসনের সঙ্গে সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন যুক্ত থাকলেও এবার তা কেটে ফরিদপুর-৪ আসনের (ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন ও সদরপুর) সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-২ আসনের ভোটার ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ১৩৫ জন। ফরিদপুর-৪ আসনে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৬ জন। ফলে এখানেও জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিতে দেখা যায়নি ইসিকে।

কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান তিতাস সমকালকে জানিয়েছেন, এই ইউনিয়নে ৩০ হাজারের বেশি ভোটার। অধিকাংশই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এ কারণে এই আসন নিয়ে সম্ভাব্য এমপিদের আগ্রহ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক উপজেলা হিসেবে তাঁরা সদরপুরের সঙ্গে যুক্ত। তবে এটি ফরিদপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এই আসনের এমপি দুই উপজেলা নিয়ে মনোযোগী। বিচ্ছিন্ন এই ইউনিয়নের দিকে গত ১৪ বছরে কেউই তাকাননি। এই আসনে সাবেক সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর চৌধুরী লাবু বর্তমান এমপি।

এ ছাড়া নোয়াখালী-১ ও ২ আসনের সীমানায় একটি ইউনিয়ন রদবদল করা হয়েছে। নোয়াখালী-১ থেকে বজরা ইউনিয়ন কেটে নোয়াখালী-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণের কারণে নোয়াখালী-১ আসনটি এখন চাটখিল এবং বারগাঁও, নাটেম্বর, অম্বর নগর ও বজরা ইউনিয়ন বাদে সোনাইমুড়ী নিয়ে গঠিত। আর নোয়াখালী-২ আসনটি সেনবাগ এবং সোনাইমুড়ীর বারগাঁও, নাটেম্বর, অম্বর নগর ও বজরা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছে।