আওয়ামী লীগের ভাবনায় মোকাবিলা কৌশল

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি কৌশল নির্ধারণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংলাপ। জাতীয় নির্বাচনের তিন থেকে চার মাস আগে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংলাপের মাধ্যমেই সংকটের সমাধান হবে– এমনটি মনে করছেন না আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস মিলেছে। যদিও এ প্রসঙ্গে কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে গত তিন দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একাধিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ দূতের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়। মধ্যস্থতা ছাড়াই সরাসরি দুই দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব পর্যায়ে আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মধ্যেও সংলাপ হয়। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। এবার হবে– এমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন তাঁরা।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে বিএনপির আন্দোলন যৌক্তিক পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা যদি নির্বাচনে অংশও নেয়, অনেক আসনে তাদের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে। ২০১৮ সালের মতো একই আসনে একাধিক প্রার্থী দাঁড়ালে

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন নেতৃত্ব বিএনপিতে এই মুহূর্তে নেই।
নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বৈরী সম্পর্ক নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা এবং তৈরি পোশাক খাত নিয়ে বিরূপ কোনো সিদ্ধান্তও আসতে পারে। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলটির ভাবনা তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতিসংঘ যতটা কম খরচে বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষী পাচ্ছে, সেটা ইউরোপ থেকে নিতে হলে অনেক খরচ বেড়ে যাবে। জাতিসংঘের পক্ষে এ মুহূর্তে খরচ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সদস্যরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ ও যোগ্য। চীন ও ভারতের পক্ষে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

তিনি জানান, আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া এবং এর পরপরই অর্থনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁদের সফরের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। এই সফর বাতিল হলেও সরকারের জন্য একটা বার্তা বহন করবে বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, এমনকি নির্বাচন হতেও দেবে না– এ ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। অথচ তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেওয়ার জন্য তাদের ২০১৪ সালেও আহ্বান জানানো হয়েছিল। তারা প্রত্যাখ্যান করে। এবারও তারা চাইলে সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সংবিধানে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সে জন্য তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক খান আরও বলেন, বিদেশিদের পেছনে ঘুরে বিএনপি কিছু অর্জন করতে পারবে না। কারণ, মার্কিন রাষ্ট্রদূতও এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। সংবিধানবিরোধী কোনো বিষয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে অনুরোধ জানাতে পারেন না বলে জানিয়েছেন। ওই বৈঠকে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এই সময়ে পঞ্চম থেকে একাদশ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বাকি নির্বাচনের আগে ও পরে দুই বড় রাজনৈতিক শক্তি রাজপথে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শান্তিপূর্ণ এ দুই নির্বাচনে একবার আওয়ামী লীগ এবং একবার বিএনপি জয়ী হয়। এ ছাড়া সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের পদত্যাগের পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে পঞ্চম সংসদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনের ফলও ছিল সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিএনপিদলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ সংসদ মাত্র চার দিনের মাথায় ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগদলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গঠিত সংসদ নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট এখনও চলমান।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক অনেকটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট এই রাজনৈতিক সংকট অবশ্যই কেটে যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই সংকটের স্থায়ী সমাধানও একদিন হবে। সেই সময় হয়তো খুব বেশি দূরে নয়।

আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক বলেন, নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ সংলাপের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু সংলাপ হবে কী নিয়ে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপের সুযোগ নেই। সংবিধানের মধ্যে থেকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় খুঁজে বের করার বিষয় নিয়ে সংলাপ হতে পারে। বিএনপির বর্তমান অবস্থান (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না) বজায় রেখে সংলাপে বসবে না আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাঁরা মনে করেন, সংলাপ ও আলোচনায় সমস্যা সমাধানে কখনোই আগ্রহী নয় বিএনপি। ফলে সংলাপের ডাক দিয়ে দায় থেকে মুক্ত হতে পারবে আওয়ামী লীগ। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে সংলাপকে ব্যবহার করা হতে পারে।